Tuesday, November 4, 2025
HomeScrollFourth Pillar | গব্বর সিংয়ের মতো আতঙ্ক নিয়ে হাজির স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন,...
Fourth Pillar

Fourth Pillar | গব্বর সিংয়ের মতো আতঙ্ক নিয়ে হাজির স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন, এসআইআর

নির্বাচন কমিশনের মূল উদ্দেশ্য এমন ভোটার তালিকা তৈরি করা, যা হবে ভুলমুক্ত এবং স্বচ্ছ

স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন বা এসআইআর (SIR) নামটাই বাংলার মানুষের মনে নতুন করে ভয় ঢুকিয়েছে। ইতিমধ্যেই একটা আত্মহত্যার কথা জানা যাচ্ছে, অন্য আরেকটা আত্মহত্যার চেষ্টার কথাও জেনেছি আমরা। হ্যাঁ, এক বাঙালির কাছে এক অস্তিত্ত্বের সংকট নিয়ে হাজির এই এসআইআর। নির্বাচন কমিশন বলছে, এটা ভোটার তালিকা সংশোধনের একটা নিবিড় প্রক্রিয়া মাত্র। কিন্তু আমরা খুব ভালো করেই জানি যে, এটা নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার এক গোপন পরীক্ষা। সংবিধানের ৩২৪ ধারাতে নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা তৈরি ও পরিমার্জন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তালিকা যেন ত্রুটিমুক্ত হয়, সেটাও নিশ্চিত করা কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু এই এসআইআর কেবল ভোটার তালিকা সংশোধনের ব্যাপার নয়। মানুষ জানেন, সব বোঝেন। যদি শুধু ভোটারের নাম সংশোধন হয়, তবে কেন এত পুরানো এবং জটিল নথিপত্র চাওয়া হচ্ছে? নির্বাচন কমিশন দেশের মোট ১২টি রাজ্য আর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এসআইআর-এর দ্বিতীয় দফা শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গ এই রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, ছত্তিশগড়, গুজরাত, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশসহ আরও অনেক রাজ্যে এই কাজ চলছে। এই ১২টি রাজ্যের মধ্যে চারটি রাজ্য – পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরল এবং পুদুচেরিতে ২০২৬ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কেন? এমনিতেই বলে তাড়াহুড়োর কাজ শয়তানের। হ্যাঁ, এটা শয়তানিই। কমিশন এক বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে। তারা বলেছে, ভোটার তালিকা ম্যাপিংয়ের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। বিহারে যখন এই কথা বলা হল, সেই সময়ে প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ বাকি ছিল। কমিশন মাত্র সাত দিনের মধ্যে এই কাজ শেষ করার কড়া নির্দেশ দিয়েছিল। প্রশাসনিকভাবে এত অল্প সময়ে এত বড় কাজ শেষ করার তাড়া এক অস্বাভাবিক চাপ তৈরি করে। এই চাপই ভয়ের মূল কারণ। কারণ তাড়াহুড়োতে কত ভুলভ্রান্তি থাকবে, আর সেই ভুলের খেসারত কত নিরীহ নাগরিককে দিতে হবে, সেটাই প্রথম আর প্রধান চিন্তা। এই বাংলাতে মাত্র মাসখানেকের এক সময়ের মধ্যে এই সমস্ত, মানে প্রায় সাড়ে সাত কোটি ভোটারের সমস্ত তথ্য খুঁটিয়ে দেখে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ২০২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা হবে। এটা অসম্ভব, এটা বোঝা যাবে তালিকা বেরোবার পর। এই ধরনের এক বিরাট সমীক্ষার কাজ এত তাড়াতাড়ি শেষ করার চাপ দেওয়ার ফলে গুণগত মান বজায় রাখা কঠিন হবে। যখন ডেডলাইন এরকম অবাস্তব কঠোর হয়, তখন ফিল্ডে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা তাড়াহুড়োতে কাজ সারতে গিয়ে ভুলের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবেন, দিতে বাধ্য হবেন। আর সেই প্রশাসনিক ত্রুটিগুলোর চূড়ান্ত মাশুল দিতে হবে সাধারণ মানুষকে।

আবার দেখুন নির্বাচন কমিশনের মূল উদ্দেশ্যটা কী? মূল উদ্দেশ্য হল, এমন ভোটার তালিকা তৈরি করা, যা হবে ভুলমুক্ত এবং স্বচ্ছ। কিন্তু তারা বলছে, এই নিবিড় সংশোধনের লক্ষ্য হল সব যোগ্য নাগরিককে তালিকায় আনা। হ্যাঁ, তারা এই নাগরিকত্বের প্রশ্নটাকে জুড়েই বিষয়টার এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যা গত ২০০২ সালের নিবিড় সংশোধনীতে ছিল না। আর তার সঙ্গে আরএসএস-বিজেপি এখন প্রকাশ্যেই জানাচ্ছে এই এসআইআর দিয়েই তারা ঘুসপেটিয়া, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে দেশ থেকে তাড়াবে। মানে নির্বাচন কমিশন যা বলছে, ঠিক একই কথা বলছে বিজেপি-আরএসএস নেতারা। ওদিকে কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়েই কমিশন বারবার বলেছে যে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়লে তার নাগরিকত্ব বাতিল হবে না। তারা আরও জানিয়েছে যে, ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিলের প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন। কিন্তু বাস্তবে, মাঠে নাম যাচাইয়ের প্রক্রিয়া এমনভাবে চলছে, যা সাফ বলে দেয় এই এসআইআর-এর উদ্দ্যেশ্যটাই আলাদা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে যাচাইয়ের পদ্ধতি নিয়েই। এখনকার ভোটারদের তথ্য যাচাই করার জন্য ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে নাম মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি কোনও ভোটারের বাবা-মায়ের নাম পুরানো তালিকায় না থাকে বা নথিপত্রে সামান্য ভুল থাকে, তবে আনুষ্ঠানিক শুনানির মুখোমুখি হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন এই ২০০২ সাল? তার পরের নির্বাচনে যাঁরা ভোট দিলেন তাঁরা কারা? কেন তারপরের সব তালিকাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে? বাবা মায়ের নাম থাকাটা বাধ্যতামূলক কী না? এমনকি ভোটার লিস্টেও নাম থাকাটাও আমাদের দেশের আইনে কোথাও বাধ্যতামূলক তো নয়। কারও তো মনে হতেই পারে যে, এই ভোট দিয়ে কিছুই হয়নি, কিছুই হয় না। তাহলে তার খামোখা এই ভোটার লিস্টে নাম তোলার জন্য ‘গায়ে আমার পূলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর’, এমনটা হবার তো কথা নয়। তাই বহু মানুষের মনে স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠছে, কেন ২১ বছর আগের নথিপত্র দিয়ে বর্তমান নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে? আর সেই প্রশ্নগুলোই জনগণের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ভোটে জমজমাট বিহার, ইন্ডিয়া জোটের ইশতেহার

এই মুহুর্তে আপনি যা যা করতে চান, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে, প্লেনের টিকিট থেকে মোবাইল ফোনের কানেকশন, আপনার কাছে আধার কার্ড চাওয়া হবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আধার কার্ডকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। তাহলে যে আধার কার্ড দিয়েই পাসপোর্ট তৈরি হচ্ছে, যে আধার কার্ড দিয়ে ভোটার কার্ড তৈরি হচ্ছে, বাড়ি ঘর কেনা বেচা যাচ্ছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা যাচ্ছে, সেই আধার কার্ড দিয়েই কেন ভোটার কার্ড করা যাবে না? মানুষজন পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে, সরকার ঘুরিয়ে নাক ধরে এখন এনআরসি বা এনপিআর (NRC/NPR)- চালু করতে চায়। আর সেটাই আতঙ্ককে উসকে দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন আইনিভাবে নাগরিকত্ব যাচাই না করলেও, তারা সুপ্রিম কোর্টে অসমের অবৈধ অভিবাসী শনাক্তকরণ মামলার রায়ের উল্লেখ করেছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে দেয় যে, কমিশনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ভোটার রোল পরিষ্কার রাখা নয়, এর পিছনে অবৈধ অভিবাসী চিহ্নিত করার এক বড়সড় রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাই কাজ করছে। সাধারণ মানুষ মনে করছে যে, এটা শুধুমাত্র প্রশাসনিক কাজ নয়, বরং নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রথম ধাপ। রাজ্যের ‘টাচ মি নট’ বিরোধী দলনেতার ভূগোল জ্ঞান নিয়ে তো প্রশ্ন তোলাই যায়, উনি চান রাজ্যে ঢুকে পড়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের বেছে আবার তাঁদের দেশে পাঠাতে। তো রোহিঙ্গারা কোথাকার বাসিন্দা? বার্মা বা মায়নামারের। কোন কোন রাজ্যের সঙ্গে ঐ মায়নামারের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে? সরাসরি সীমান্ত আছে অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর আর মিজোরামের। বাংলাদেশের সঙ্গে বর্ডার আছে ত্রিপুরা, অসম আর পশ্চিমবাংলার। কিন্তু দেখুন রোহিঙ্গা চিহ্নিতকরণ বা অনুপ্রবেশকারী বেছে বের করাটাই যদি প্রধান উদ্দেশ্য হয়, তবে বাংলাদেশ বা বার্মার সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্য অসম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর, ত্রিপুরা বা অরুণাচল প্রদেশে কেন এসআইআর করা হচ্ছে না? কারণ আমরা সব্বাই জানি, অসমে এনআরসি করতে গিয়ে মুখ পুড়েছে বিজেপির। ১৯ লক্ষ ডি-ভোটারের মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু ছিলেন। সেই সমীক্ষাটাকে তুলে রাখা হয়েছে। এখন তাদের মাথায় ঢুকেছে, এই নিবিড় ভোটার সংশোধনের নাম করে এই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। কিন্তু আজ বলছি মিলিয়ে নেবেন, এবারেও আবার মুখ পুড়বে ঐ বিজেপির, আবার এক বিরাট সংখ্যক হিন্দু দলিত আদিবাসীদের নাম বাদ পড়বে, রাজবংশী, মতুয়াদের নাম বাদ পড়বে। আর তখন মুখ দেখানোর জায়গাও পাবে না এই বঙ্গ বিজেপির নেতারা। উত্তরবঙ্গে যেটুকু সামান্য কিছু শক্তি বাড়িয়েছিলেন, তা এক মুহুর্তে ভোগে চলে যাবে।

কিন্তু এটাও সত্যি যে, ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই প্রক্রিয়া ব্যাপক মানসিক আতঙ্ক তৈরি করেছে। হাজার হাজার পরিবার তাঁদের নাগরিকত্ব টিকিয়ে রাখার ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। নথিপত্রের সামান্য ত্রুটি হলেই তাঁদের নাম বাদ পড়তে পারে, এই ভয়ে তারা কুঁকড়ে আছে। বিজেপি বিরোধী সমস্ত দলের উচিত তাঁদের আস্বস্ত করা, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। বৈধ, অবৈধ, প্রকৃত, অপ্রকৃত কী না, তা বিচার করে নয়, যে মানুষটির নাম কাটা পড়বে, তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে, যাকে ডি-ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। এতদিন যাদের সঙ্গে খেলার মাঠ থেকে স্কুল থেকে হরিনামের আটচালা থেকে জায়নমাজের উদার জমিন ভাগ করেই থেকেছি বেঁধে বেঁধে, তাঁদের একজনকেও বেনাগরিক হতে দেব না।

Read More

Latest News